নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার:
# এক মাসেও সরকারি গুদামে উঠেনি একমুঠো ধান-চাল
# লোকসানের ভয়ে গা ডাকা দিয়েছেন মিলাররা
# জমি থেকে উৎপাদিত ধান যাচ্ছে সিন্ডিকেট বেপারীদের হাতে
কক্সবাজার জেলায় সরকারিভাবে ধান চাল সংগ্রহ শুরু হয়েছে গত একমাসের কাছাকাছি। কিন্তু এত দিনে মৌসুমের লক্ষ্যমাত্রার ১ শতাংশ ধানও উঠেনি সরকারি গুদামে। বাজারমূল্য ও সরকারি দামে প্রায় সমান হওয়া ছাড়াও সোনালি ব্যাংকে কৃষকের নিজস্ব একাউন্ট খোলাসহ নানাবিধ সমস্যার কারণে ধান বিক্রিতে অনীহা দেখা দিয়েছে কৃষকের মাঝে।
এছাড়া ধানের পাশাপাশি চালের দাম বেশি হওয়ায় চালকল মালিকরাও গুদামে চাল দিতে আগ্রহী নন। তবে কিছু মিলার লাইসেন্স বাতিলের ভয়ে লোকসানে চাল দিতে আগ্রহী হয়েছে বলে জানা যায়।
গত ২৩ নভেম্বর থেকে ধান ও চাল ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এতে ধান কেজিপ্রতি ৩০ টাকা, আমন সেদ্ধ ৪৪ টাকা ও আতপ ৪৩ টাকা করে ক্রয়ের ঘোষণা দেয়। কিন্তু গত একমাসের কাছাকাছি সময় অতিবাহিত হলে-ও এখনো পর্যন্ত এক ছটাক ধান-চাল উঠেনি সরকারি গুদামে। ফলে চলতি আমন মৌসুমে ধান এবং চাল সংগ্রহের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, তা বাস্তবায়নে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। যদিও ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রার ৭০ শতাংশ ধান-চাল সংগ্রহ নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেওয়া ছিল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে।
কৃষকরা খাদ্যগুদামে ধান বিক্রি না করার কারণ হিসেবে দেখা গেছে, আমন মৌসুমের শুরু থেকেই খোলা বাজারে প্রতি মণ শুকনো ধান বিক্রি হচ্ছে ১১২০ থেকে ১১৫০ টাকা করে। আর সরাসরি মাঠে মধ্যেই ব্যাপারীদের কাছে কৃষকরা কাঁচা ধান বিক্রি করতে পারছেন মণ প্রতি এক হাজার থেকে এক হাজার ২০ বা ৫০ টাকা করে। যদিও পুরোপুরি শুকনো প্রতি মণ ধানের সরকারি নির্ধারিত মূল্য ১২০০ টাকা।
অন্যদিকে সরকারি তালিকাভুক্ত কৃষকরাই লটারির মাধ্যমে ধান বিক্রি করতে পারবে। গুদামে ধান বিক্রির এমন প্রক্রিয়াকে জটিল মনে করেন কৃষকরা। ব্যাপারীরা কৃষকের ঘরে ঘরে গিয়ে ধান সংগ্রহ করছে। তাই ব্যাপারীদের কাছে তাদের উৎপাদিত ধান বিক্রি করে দিচ্ছেন জেলার কয়েক হাজার কৃষক।
যদি-ও মিল মালিকরা বলছেন, সরকার ধান ও চাল সংগ্রহের যে মূল্য নির্ধারণ করেছে তা বাজারের দামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে লোকসানের ভয়ে সরকারের গুদামে চাল দিতে চান না তারা। এ অবস্থায় মিলারদের ইনসেনটিভ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। এছাড়া গত কয়েক মৌসুম ধরে সরকারের গুদামে চাল দিতে গিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে বলেও দাবি মিলারদের।
মিল মালিক সদর উপজেলার জনতা অটো রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী নুরুল আকতার জানান, সরকার যে দাম নির্ধারন করেছে তার কম দামে বাজারে চাল বিক্রি হচ্ছে। এর আগেও লোকসান দিতে হয়েছে। আর কত লোকসান দেবো।
উখিয়ার মিল মালিক কবির আহমেদ বলেন, সরকার আমন মৌসুমে ৭ টন বরাদ্দের কথা বলেছে। চুক্তিও হয়েছে। এ অবস্থায় বাজারে চালের দাম নিয়ে হিসেব যেন মেলাতে পারছেন না তিনি। গত মৌসুমে সরকারকে ৪৯ টন চাল দিয়েছেন। তারমধ্যে তার ১২ – ১৫ লক্ষ টাকা লোকসান হয়েছে বলে তিনি জানান।
জেলা চালকল মালিক সমিতির সভাপতি ফজল করিম বলেন, চকরিয়া ও পেকুয়া ৬০ টির মিল রয়েছে। যারমধ্যে ১৭ টির লাইসেন্স আছে। সরকার-নির্ধারিত দামের চেয়ে চালের উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় লোকসানের ভয়ে মিলাররা সরকারি গুদামে চাল সরবরাহ করতে আগ্রহী হচ্ছেন না।’
নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একজন মিলার বলেন, আমরা ধান কিনে চালকলে ভেঙে বাজারে বিক্রি করি। মূলত এটাই আমাদের ব্যবসা। কিন্তু সরকার যে দাম দিয়েছে সে দামে চাল দেওয়া সম্ভব নয়?
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি আমন মৌসুমে ১৪ হাজার ২৮২ মেট্রিক টন ধান ও চালের লক্ষ্যমাত্রা করা হয়েছে। যারমধ্যে ধান ২ হাজার ৬২৩ মেট্রিক টন। যা ২০২২ সালে ধানের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৪ হাজার ৩০৫ মেট্রিক টন। সেদ্ধ ১৮৬৪ মেট্রিক টন ও আতপ ৯ হাজার ৭৯৫ মেট্রিক টন। সদর থেকে চাল ৭৭১ টন’ ধান ১৫৬ টন, চকরিয়া চাল ২৬৬৯ টন’ ধান ৬৭১ টন, পেকুয়া চাল ৪১৬ টন’ ধান ২৭৪ টন, মহেশখালী চাল ৭০ টন’ ধান ২৬৭ টন, রামু চাল ৩০০৬ টন’ ধান ৩১২ টন, উখিয়া চাল ১৫৯৪ টন’ ধান ৩১৫ টন, টেকনাফ চাল ৬৯০ টন’ ধান ৩৫৭ টন, ঈদগাহ চাল ৫৭৯ টন’ ধান ১৪০ টন এবং কুতুবদিয়া চালের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়নি। তবে ১৩১ মেট্রিক টন ধানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অফিসের উচ্চমান সহকারী নির্মল দাশ বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত সময় আছে। এছাড়া ধান হতে হবে শুকনো, চিটামুক্ত, উজ্জ্বল ও সোনালি বর্ণের। যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষা করে এসব গুণাগুণ পাওয়া গেলে তবেই সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করা যাবে। তিনি বলেন অনেক মিল মালিকদের সাথে চুক্তি হয়েছে। হয়তো মাসের শেষের দিকে চাল সংগ্রহ করতে পারবো। তিনি বলেন, ‘১৪ হাজার ২৮২ মেট্রিক চাল ও ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। তারমধ্যে ধান ২ হাজার ৬২৩ মেট্রিক টন, আতপ ৯ হাজার ৭৯৫ মেট্রিক টন এবং সেদ্ধ ১৮৬৪ মেট্রিক টন।
জানা যায়, সদরে একটি সেদ্ধ চালের মিল ও ৮ উপজেলায় ৭৫ টি বৈধ মিল রয়েছে। প্রতি বছর সরকারের দেওয়া দাম নিয়ে চুক্তিভিত্তিতে সরকার চাল ও ধান ক্রয় করেন। কিন্তু চলতি মৌসুমে এক মাসের কাছাকাছি সময় পার হয়ে গেলেও এখনো সরকারি গুদামে ধান ও চাল উঠেনি। ৭৫ টি মিল মালিকদের মধ্যে এখনো অর্ধেকও চুক্তি হয়নি। ফলে লক্ষ্যমাত্রা নিয়েও দেখা দিয়েছে ঘাটতি।
এ বিষয়ে কথা বলতে বেশ কয়েকবার কল করেও পাওয়া যায়নি জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা সৈয়দ আতিকুল হককে।
প্রসঙ্গত, চলতি মৌসুমে সাত লাখ মেট্রিক টন আমন ধান ও চাল কিনবে সরকার। এরমধ্যে ৪ লাখ টন সিদ্ধ ও এক লাখ টন আতপ চাল এবং ২ লাখ টন আমন ধান কেনা হবে জানা গেছে।
পাঠকের মতামত: